হজ মূলত তিন প্রকার। তামাত্তু, কিরান ও ইফরাদ। এখানে প্রত্যেক প্রকারের হজ কীভাবে আদায় করতে হয় সবিস্তারে তা বর্ণনা করা হলো।
হজে তামাত্তু আদায়ের পদ্ধতি
তামাত্তু মানে হলো সুবিধা ভোগ করা। যারা ওমরাহ ও হজের মাঝে হালাল হয়ে ইহরাম খুলে ফেলেন তাদের এই আমলকে তামাত্তু হজ বলে। বাংলাদেশ থেকে যারা পবিত্র হজে গমন করেন, তারা সাধারণত তামাত্তু হজ আদায় করে থাকেন।
তামাত্তু হজকারীদের নিচে বর্ণিত কাজগুলো ধারাবাহিকভাবে আদায় করতে হবে। ৮ জিলহজের আগেই তাদের ওমরাহ পালন করতে হবে। তারপর ৮ জিলহজ থেকে হজের কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে।
মক্কা শরিফ গমনকারীদের নিজ নিজ মিকাত অতিক্রমের আগেই ওমরাহর নিয়তে ইহরাম বাঁধা ফরজ। দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে শুধু ওমরাহর নিয়ত করবে এবং তালবিয়া পড়বে:
লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়ালমুলক, লা শারিকা লাকা। (বুখারি ১৪৪৮)
মিকাত পরিচয়ে অক্ষম ব্যক্তিদের বিমানবন্দরে পৌঁছার আগে অথবা বিমানবন্দর থেকেই ইহরাম বেঁধে নিতে হবে।
তারপর ওমরাহ করবে, অর্থাৎ ওজুর সঙ্গে বাইতুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করা ফরজ। এ তাওয়াফ এবং যেসব তাওয়াফের পর সায়ি করা হয়, সেসব তাওয়াফের সময় দুটি বিষয় লক্ষণীয়। এক. ‘ইজতিবা’, অর্থাৎ ডান হাতের নিচ দিক থেকে ইহরামের কাপড় বাঁ কাঁধে রাখা মুস্তাহাব। দুই. প্রথম তিন চক্করের সময় ‘রমল’ করা; অর্থাৎ পুরুষরা দ্রুতগতিতে বীরদর্পে চলা সুন্নত। তাওয়াফ শেষে সম্ভব হলে মাকামে ইব্রাহিমের পেছনে, অন্যথায় হারাম শরিফের যেকোনো স্থানে (মাকরুহ সময় ছাড়া) দুই রাকাত নামাজ পড়া ওয়াজিব। তারপর সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার সায়ি করা ওয়াজিব।
অতঃপর পুরুষদের মাথা মুণ্ডানো বা পুরো মাথা ছাঁটানো আর মহিলাদের চুলের এক ইঞ্চি পরিমাণ কেটে ফেলা ওয়াজিব। এতেই ওমরাহ সমাপ্ত হয়ে যায়। তারপর ইহরাম খুলে যাবতীয় কাজ স্বাভাবিকভাবে করা যাবে।
তামাত্তু হজকারীদের ৮ জিলহজ হারামের সীমানার যেকোনো স্থান থেকে তথা নিজ বাসা, ঘর, হারাম শরিফ থেকে হজের নিয়তে পুনরায় ইহরাম বেঁধে জোহরের আগে মিনায় পৌঁছতে হবে। ৮ তারিখ জোহর থেকে ৯ তারিখ ফজর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করা সুন্নত।
৯ জিলহজ করণীয়
জিলহজের ৯ তারিখ সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পর মিনা থেকে আরাফার দিকে যাত্রা করবে। সেদিন সূর্য হেলার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। তাঁবুতে অবস্থানকারীরা জোহর ও আসর নামাজ নিজ নিজ সময়ে মুকিম হলে চার রাকাত এবং মুসাফির হলে দুই রাকাত করে আদায় করবেন। তবে মসজিদে নামিরার জামাতে পড়লে একসময়েও আদায় করা যাবে। স্মরণ রাখতে হবে যে, আরাফার সঠিক সীমান্তে পৌঁছতে ভুল করলে হজ আদায় হবে না।
সূর্যাস্তের পর মাগরিব না পড়েই মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা হতে হবে। মাগরিবের ওয়াক্ত চলে গেলেও, রাত গভীর হলেও মুজদালিফায় পৌঁছার পরেই মাগরিব ও এশার নামাজ একত্রে পড়তে হবে। কেননা মুজদালিফায় পৌঁছে মাগরিব ও এশা এক আজান ও দুই ইকামতে একসঙ্গে আদায় করা ওয়াজিব। এখানে রাত যাপন করা সুন্নত আর ১০ জিলহজ ফজরের পর সূর্যোদয়ের আগে কিছু সময় মুজদালিফায় অবস্থান করতে হবে। কেননা ১০ তারিখ সুবহে সাদিকের পর কিছু সময় মুজদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। তবে দুর্বল ও মহিলাদের জন্য রাতেই মিনার উদ্দেশে রওনা হওয়া বৈধ।
জিলহজের ১০ তারিখ সুবহে সাদিকের পর কিছু সময় মুজদালিফায় অবস্থান করে মিনার উদ্দেশে যাত্রা করবে এবং মিনায় পৌঁছে কেবল বড় জামারায় (শয়তানকে) সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। ১০ তারিখ সুবহে সাদিকের পর থেকে পরদিন সুবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত যেকোনো সময় এই কঙ্কর নিক্ষেপ করা যাবে। যদি এই সময়ের মধ্যে কঙ্কর নিক্ষেপ করা না হয়, তবে দম দিতে হবে। এটি সূর্যাস্তের আগে করতে পারলে ভালো।
১০ জিলহজ কঙ্কর মারার পরই দমে শোকর বা দমে তামাত্তু- যাকে হজের কোরবানি বলা হয়, নিশ্চিত পন্থায় তা আদায় করা ওয়াজিব। কোরবানির পরেই মাথা হলক করা ওয়াজিব। তবে চুল ছোটও করা যাবে। মনে রাখতে হবে, হাদি বা কোরবানির পশু অন্যকে দিয়ে জবাই করানো হলে জবাইয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
কোরবানির পর মাথা মুণ্ডানো বা ছাঁটানোর পর ইহরাম খুলে সব কিছুই স্বাভাবিকভাবে করতে পারবেন, এমনকি স্বাভাবিক কাপড় পরেও তাওয়াফে জেয়ারত করা যাবে। তবে তাওয়াফে জেয়ারতের আগে স্বামী-স্ত্রী মিলন বৈধ হবে না।
কঙ্কর মারা, কোরবানি করা ও চুল কাটার মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ওয়াজিব, ব্যতিক্রম হলে ‘দম’ দিতে হবে।
তাওয়াফে জেয়ারত বা হজের ফরজ তাওয়াফ করে সাফা-মারওয়া সায়ি করা ওয়াজিব। সম্ভব হলে সেই তাওয়াফ ১০ তারিখে করা ভালো। অন্যথায় ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগে আগেই আদায় করা ওয়াজিব। হলক বা মাথা মুণ্ডানোর পরই এই তাওয়াফ করা সুন্নাত। কারণবশত এর আগেও বৈধ আছে। তাওয়াফে জিয়ারতের পর স্বামী-স্ত্রী মিলনও বৈধ হয়ে যায়।
জিলহজের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ করণীয়
১১, ১২ তারিখে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় জামারায় উভয় দিন সাতটি করে ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। ছোট জামারা থেকে শুরু করে বড় জামারায় তা শেষ করবে। সূর্য হেলার পর থেকে পরদিন সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় এই কঙ্কর নিক্ষেপ করা যাবে। সূর্যাস্তের আগে সম্ভব হলে ভালো। তবে বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে, সূর্য হেলার আগে নিক্ষেপ করলে আদায় হবে না; বরং সূর্য হেলার পর আবার নিক্ষেপ করতে হবে। অন্যথায় দম দিতে হবে। এটাই নির্ভরযোগ্য ফতোয়া। তবে অতি ভিড় বা অন্য কোনো অসুবিধার কারণে সূর্য হেলার আগে নিক্ষেপ করলে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর এক বর্ণনামতে বৈধ হয়ে যাবে।
১৩ তারিখ সূর্য হেলার পর কঙ্কর নিক্ষেপ করে মিনা ত্যাগ করা সুন্নত। তবে কেউ যদি ১২ তারিখে চলে আসতে চান, তাহলে ওই দিন সূর্য হেলার পর থেকে পরদিন সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় পাথর মেরে চলে আসতে পারবেন। কিন্তু যদি কেউ ১৩ জিলহজ সুবহে সাদিকের পর মিনায় অবস্থান করেন, তাহলে তার জন্য ১৩ তারিখেও কঙ্কর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। অন্যথায় দম দিতে হবে। ১২ তারিখের পর একজন হাজি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন।
তারপর মিনা থেকে মক্কা এসে বিদায়ি তাওয়াফ করা ওয়াজিব। বাংলাদেশি হজযাত্রীদের হজ শেষে বিদায়ি তাওয়াফ করতে হয়, এটি ওয়াজিব। তবে হজ শেষে যেকোনো নফল তাওয়াফ-ই বিদায়ি তাওয়াফে পরিণত হয়ে যায়। নারীদের মাসিকের কারণে বিদায়ী তাওয়াফ করতে না পারলে কোনো ক্ষতি নেই; দম দিতে হয় না।
কিরান মানে হলো মিলানো। যারা হজ ও ওমরাহ একই ইহরামে করেন তাদের এ আমলকে হজে কিরান বলে। কিরান হজকারীদের জন্য মিকাত অতিক্রমের আগেই একসঙ্গে হজ ও ওমরার নিয়তে ইহরাম বাঁধা ফরজ। আর মক্কা শরিফ পৌঁছে ওমরাহ তথা তাওয়াফ করা, দুই রাকাত নামাজ পড়া, সায়ি করা অতঃপর ইহরাম অবস্থায়ই থাকতে হবে। সম্ভব হলে এ সময় তাওয়াফে কুদুম বা আগমনি তাওয়াফ করা সুন্নত।
আগের ইহরামেই ৮ তারিখ জোহরের আগে মিনায় পৌঁছে যেতে হবে। আর বাকি দিনগুলোতে- অর্থাৎ জিলহজের ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ হজে তামাত্তু-এ উল্লিখিত নিয়মে করণীয়গুলো পালন করতে হবে।
ইফরাদ মানে একটি কাজ করা। যারা শুধু হজ করতে যান তাদের আমলকে হজে ইফরাদ বলে। ইফরাদ হজকারীদের জন্য মিকাত অতিক্রমের আগেই শুধু হজের নিয়তে ইহরাম বাঁধা ফরজ এবং মক্কা শরিফ পৌঁছে কেবল তাওয়াফে কুদুম বা আগমনি তাওয়াফ করা সুন্নাত। এছাড়া তারা জিলহজের ৮, ১০, ১১, ১২, ১৩ তারিখ হজের বাকি কাজগুলো হজে তামাত্তুর নিয়মে পালন করবেন। তবে কোরবানি করতে হবে না। কেননা ইফরাদ হজকারীদের জন্য কোরবানি নেই। এমনকি মক্কা শরিফ পৌঁছে তাওয়াফে কুদুমের পর সায়ি করে থাকলে তাওয়াফে জেয়ারতের পর সায়ি-ও করতে হবে না।